আনন্দ খবর ডেস্ক প্রকাশিত: ১৯ ডিসেম্বর, ২০২৫, ০১:১২ এএম

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের এক লড়াকু যোদ্ধা, ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক শরিফ ওসমান হাদি আর আমাদের মাঝে নেই। দীর্ঘ সাত দিন মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ে ১৮ ডিসেম্বর সিঙ্গাপুরের একটি হাসপাতালে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন। একটি গুলি কীভাবে একটি জীবন প্রদীপ নিভিয়ে দিল? গত ১২ ডিসেম্বর ঢাকার রাজপথে ঠিক কী ঘটেছিল? কীভাবে প্রশাসনের চোখে ধুলো দিয়ে বর্ডার পার হলো খুনিরা? আজকের আমরা জানাব ওসমান হাদির ওপর হামলার শুরু থেকে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়া পর্যন্ত গত সাত দিনের প্রতিটি মুহূর্তের বিস্তারিত ঘটনাপ্রবাহ।
ঘটনার শুরুটা ছিল ১২ ডিসেম্বর, শুক্রবার। জুমার নামাজের পর ঢাকার পুরানা পল্টনের ব্যস্ত রাস্তায় একটি ব্যাটারিচালিত রিকশায় যাচ্ছিলেন ওসমান হাদি। ঘড়িতে তখন দুপুর ২টা ২৪ মিনিট। হঠাৎ পেছন থেকে একটি মোটরসাইকেল তাদের অনুসরণ করতে শুরু করে। চলন্ত রিকশাতেই মোটরসাইকেলের পেছনে থাকা ব্যক্তিটি হাদিকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে। গুলিটি হাদির কানের ডান পাশ দিয়ে ঢুকে মাথার বাঁ পাশ দিয়ে বেরিয়ে যায়। মুহূর্তের মধ্যেই রক্তাক্ত অবস্থায় তিনি রিকশা থেকে লুটিয়ে পড়েন। ব্যস্ত রাস্তায় সন্ত্রাসীরা দ্রুতগতিতে মোটরসাইকেল চালিয়ে পালিয়ে যায়, আর হাদিকে দ্রুত নিয়ে যাওয়া হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে।
হাসপাতালে নেওয়ার পর চিকিৎসকরা জানান, ওসমান হাদির অবস্থা অত্যন্ত সংকটাপন্ন। তাকে তাৎক্ষণিকভাবে লাইফ সাপোর্টে নেওয়া হয় এবং নিউরোসার্জারি বিভাগের চিকিৎসকরা প্রাথমিক অস্ত্রোপচার সম্পন্ন করেন। উন্নত চিকিৎসার জন্য সেদিন রাতেই তাকে রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। এই ন্যাক্কারজনক হামলার খবর ছড়িয়ে পড়তেই রাজধানীসহ সারা দেশে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন এবং হামলাকারীদের দ্রুত গ্রেপ্তারের কঠোর নির্দেশ দেন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ করে তদন্ত শুরু করে।
ঘটনার পরদিন ১৩ ডিসেম্বর পুলিশ ও র্যাব ওসমান হাদির ওপর হামলাকারীকে শনাক্ত করতে সক্ষম হয়। তদন্তে বেরিয়ে আসে শিউরে ওঠার মতো তথ্য। সরাসরি গুলি চালানো ব্যক্তিটির নাম ফয়সাল করিম মাসুদ, যিনি নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের একজন নেতা ছিলেন। তার সহযোগী হিসেবে মোটরসাইকেল চালাচ্ছিলেন যুবলীগ কর্মী আলমগীর শেখ। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা হামলাকারীকে ধরিয়ে দেওয়ার জন্য ৫০ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেন এবং শুরু হয় ‘অপারেশন ডেভিল হান্ট ফেজ-২’। গোয়েন্দারা জানান, এই হামলার পরিকল্পনা করা হয়েছিল কয়েক মাস ধরে, যার মূল উদ্দেশ্য ছিল দেশে বড় ধরনের অস্থিতিশীলতা তৈরি করা।
১৪ ডিসেম্বর তদন্তকারী সংস্থার সূত্রে জানা যায়, ঘটনার মাত্র ১২ ঘণ্টার মধ্যেই 'শুটার' ফয়সাল এবং চালক আলমগীর ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট সীমান্ত দিয়ে ভারতে পালিয়ে গেছেন। পালানোর সময় তারা পাঁচবার যানবাহন বদলান এবং নিজেদের মুঠোফোন ও সিম ফেলে দেন। সীমান্তে মানব পাচারকারী চক্রের সহায়তায় তারা দেশত্যাগ করেন। পুলিশ সীমান্তবর্তী এলাকা থেকে এই পাচারে সহায়তাকারী সঞ্জয় চিসিম ও সিবিরন দিও নামের দুজনকে আটক করে। এদিকে ঢাকায় অভিযান চালিয়ে ফয়সালের স্ত্রী, শ্যালক এবং বান্ধবীকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করে র্যাব।
১৫ ডিসেম্বর ওসমান হাদির শারীরিক অবস্থার কোনো উন্নতি না হওয়ায় তাকে এয়ার অ্যাম্বুলেন্স যোগে সিঙ্গাপুরে নেওয়া হয়। সাথে যান বাংলাদেশি চিকিৎসক ও তার পরিবারের সদস্যরা। এদিকে দেশে তদন্ত চলতে থাকে পুরোদমে। ফয়সালের বোনের বাসা থেকে গুলি ও ম্যাগাজিন উদ্ধার করা হয়। র্যাব এবং পুলিশের যৌথ অভিযানে ঘটনার সাথে জড়িত সন্দেহে মোট ছয়জনকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়। প্রধান নির্বাচন কমিশনার এই ঘটনাকে ‘বিচ্ছিন্ন ঘটনা’ বললে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল তার তীব্র প্রতিবাদ জানায়।
১৬ ডিসেম্বর ইনকিলাব মঞ্চ এক বিবৃতিতে জানায়, সিঙ্গাপুরে নেওয়ার পর হাদির অবস্থা কিছুটা স্থিতিশীল হলেও তিনি শঙ্কামুক্ত নন। চিকিৎসকরা জানান, তার আরেকটি অস্ত্রোপচারের প্রয়োজন, কিন্তু শারীরিক অবস্থা এতটাই দুর্বল ছিল যে অপারেশন করা সম্ভব হচ্ছিল না। একই দিনে র্যাব নরসিংদীর একটি বিল থেকে হামলাকারীদের ব্যবহৃত দুটি পিস্তল ও ৪১ রাউন্ড গুলি উদ্ধার করে। এছাড়াও ফয়সালের বাবা-মা এবং তাকে পালাতে সহায়তাকারী নুরুজ্জামানকেও গ্রেপ্তার করা হয়। সব মিলিয়ে এই ঘটনায় জড়িত সন্দেহে ১৪ জনেরও বেশি ব্যক্তিকে আইনের আওতায় আনা হয়।
১৭ ডিসেম্বর প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং জানায়, ওসমান হাদির অবস্থা অত্যন্ত সংকটাপন্ন। সিঙ্গাপুরের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ভিভিয়ান বালাকৃষ্ণান হাসপাতালে হাদিকে দেখতে যান এবং তার চিকিৎসার খোঁজখবর নেন। তিনি ড. ইউনূসকে ফোন করে হাদির সংকটাপন্ন অবস্থার কথা জানান। প্রধান উপদেষ্টা দেশবাসীকে শান্ত থাকার এবং হাদির জন্য দোয়া করার আহ্বান জানান। পুরো জাতি তখনো আশায় বুক বেঁধে ছিল, হয়তো অলৌকিক কিছু ঘটবে, হয়তো লড়াকু হাদি আবারো ফিরে আসবেন রাজপথে।
কিন্তু সব চেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়ে ১৮ ডিসেম্বর, বৃহস্পতিবার রাত পৌনে ১০টায় না ফেরার দেশে চলে যান ওসমান হাদি। সিঙ্গাপুরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা এবং ইনকিলাব মঞ্চ তার মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করে। মৃত্যুর সংবাদ ছড়িয়ে পড়ার সাথে সাথেই শোকের ছায়া নেমে আসে তার সহযোদ্ধা এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে। একজন সম্ভাবনাময় তরুণ নেতা, যিনি অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন, ঘাতকের বুলেটে তার অকাল প্রয়াণ মেনে নেওয়া কঠিন।
ওসমান হাদির এই মৃত্যু কেবল একটি প্রাণের বিনাশ নয়, এটি আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি এবং নিরাপত্তার প্রশ্নে এক বড় ধাক্কা। ঘাতকরা হয়তো পালিয়েছে, কিন্তু তাদের বিচারের মুখোমুখি করা এখন সময়ের দাবি। ওসমান হাদি চলে গেলেন, কিন্তু রেখে গেলেন তার সংগ্রাম আর সাহসের গল্প। আল্লাহ তাকে জান্নাতবাসী করুন।